পোড়া চিনির বিষাক্ত লাভা কর্ণফুলী নদীতে ভেসে উঠছে মাছ ও জলজ প্রাণী
চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের চিনি কারখানার আগুনে পোড়া চিনির বিষাক্ত রাসায়নিক লাভা কর্ণফুলী নদীর পানিতে মেশার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ও দুর্বল হয়ে ভেসে উঠছে। এছাড়াও কাঁকড়া, সাপ-ব্যাঙসহ আরও জলজ প্রাণী বিভিন্ন অংশে মরে পড়ে থাকতে দেখেছেন স্থানীয়রা।
বুধবার (৬ মার্চ ) সকাল থেকে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন অংশে ভেসে ওঠা মাছ ধরতে ভিড় জমিয়েছেন শত শত মানুষ। এদিন সকালে কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগরে বাংলাবাজার খালে গিয়ে দেখা যায়, নদী ও খালের পানির রঙ বদলে লাল গেছে। অজস্র মাছ মরে ভেসে উঠেছে। বিভিন্ন বয়সী কমপক্ষে শ’দুয়েক মানুষকে ভেসে ওঠা মাছ ধরতে দেখা গেছে।
স্থানীয় সাইফুল ইসলাম বলেন, আগুনে পুড়া চিনি মিশ্রিত পানি নদীতে মেশার পর নদীর পানির রঙ লাল হয়ে গেছে। এরপর থেকে নদীতে আধমরা মাছ ভাসতে দেখি। মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাত থেকে গলদা চিংড়ি, টেংরা ও বাইল্লাসহ অনেক ধরনের ভেসে ওঠা মাছ ধরেছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আগুনের মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কর্ণফুলী নদীতে। কারণ ওইসব গলিত তরল ও ভস্মীভূত ছাইয়ে দূষিত হচ্ছে পানি, যা নদীর মাছসহ জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা নদী গবেষক ডক্টর মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, মাছ মরে যাচ্ছে মানে নদীর পানি বিষাক্ত হয়েছে। এ বিষাক্ত পানি যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত নদী দূষিত হবে। ড্রেনেজটা অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারলে ভালো হত। মাছের সঙ্গে নদীতে থাকা প্লাংকটন ও জলজ উদ্ভিদও মারা যাচ্ছে। এগুলো আমরা সাধারণত চোখে দেখি না। হালদা নদীতে এর প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা জোয়ারের ওপর নির্ভর করছে। কর্ণফুলীর এ দূষিত পানি জোয়ারের পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে যদি হালদাতে পড়ে অবশ্যই এর প্রভাব পড়বে। এতে হালদার কার্প জাতীয় প্রজনন সক্ষম মাছের ক্ষতি হবে।’
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, ‘চিনি পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু পানিতে সেটি অতিমাত্রায় মিশলে ইউট্রোফিকেশন (জলদূষণজনিত কারণে জলাশয়ে অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান সৃষ্টির মাধ্যমে প্লাংকটনের সংখ্যার আধিক্য দেখা দেয়, ফলে জলের গুণমানের ঘাটতি দেখা যায়) হয়। এখন এটি জলাশয়ে হলে জলজ প্রাণীদের বেশ ক্ষতি হয়। নদীতে ইউট্রোফিকেশন হলে অস্থায়ীভাবে সমস্যা তৈরি করতে পারে, সেটি দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে। তবে এটি যদি আবার মাস দুয়েক ধরে চলতে থাকে, তাহলে নদীর জীববৈচিত্র্য ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
এদিকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। আমরা আমাদের ঊদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। জোয়ার-ভাটা হলে এটা কমে যাবে। তবে এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিষয়টি আরও খারাপ হবে।
অপরদিকে বুধবার সকালেও কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর এলাকায় এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলসংলগ্ন নদীতে অপরিশোধিত চিনি গলে সৃষ্ট তরল পানিতে মিশতে দেখা যায়।
কারখানার যে গুদামটি আগুনে পুড়েছে, তার আয়তন ৬৫ হাজার ৭০০ বর্গফুট। মূল ফটক থেকে গুদাম পর্যন্ত পুরো রাস্তায় অপরিশোধিত চিনি গলে পরিণত হওয়া তরল পড়ে লালচে কালো কাদায় পরিণত হয়েছে। সেগুলো নালার মতো হয়ে চলে যাচ্ছে কারখানার একেবারে েেপছনে কর্ণফুলী নদীতে।
আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি: প্রায় ৪৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি এস আলম গ্রুপের চিনি কলের আগুন। বুধবার চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ হারুন পাশা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগবে। পুরো এলাকাজুড়েই চিনির কাঁচামাল মজুত আছে। শুধু নিচ থেকে আগুন নেভানো সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে ওপর থেকে পানি ছিটানোর বিকল্প নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট কাজ করছে।
এর আগে, সোমবার (৪ মার্চ) বিকেল চারটায় এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। সঙ্গে যুক্ত হন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যরাও। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাত ১১টার দিকে, আগুন লাগার সাত ঘণ্টা পর সেই আগুন আংশিক নিয়ন্ত্রণে আসে।